বেগম রোকেয়ার সমাধি

“আপনি জানতেন অবরোধ হয়
মেয়েদের জন্য অবরোধ নয়,
অবরোধ খোলা, প্রতিরোধ তোলা
লেখাপড়া শেখা , খোলা মনে দেখা
যেভাবে আপনি দেখেছেন
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

শালীনতা থাক, অবরোধ যাক
গ্রামের মেয়েটা, সাহস পাক
বই তুলে নেয়া, স্কুলে নাম দেয়া
বিজ্ঞানে যাওয়া , এগোতেই চাওয়া
যেভাবে আপনি এগিয়েছেন
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ”

আজ আসুন এক কল্প বিজ্ঞানের গল্প শোনাই আপনাদের। সে এক আজব দেশের গল্প। সেখানে মশা নেই, পুলিশ নেই, অশান্তি নেই। আর এই শান্ত আনন্দময় পরিবেশের উৎসে একটাই কারণ। পুরুষ এখানে শৃংখলাবদ্ধ। গল্পের এক চরিত্র বলছেন – স্বয়ং শয়তান যেখানে শৃংখলাবদ্ধ সেখানে শয়তানীর সুযোগ কোথায়? মেয়েরা তাই ভারী নিরাপদ। পুরুষরা রয়েছে অন্তপুরে। জননিরাপত্তার স্বার্থে হিংস্র পশু ও বদ্ধ উন্মাদের যেমন অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে নেই, তেমনি পুরুষদেরও ছেড়ে দেয়া যায় না রাস্তায়। তারা থাকে ঘরে। তারা করে দেহের কাজ। মেয়েরা করে মস্তিষ্কের কাজ। এর আছে দেহ, ওর আছে মন। বিভজনটা এই রকমের। সে দেশে যুদ্ধ পরিচালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। অবশই তিনি একজন মহিলা এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ুয়ারা সকলেই ছাত্রী। এমন এক কাল্পনিক দেশের গল্প ছাপা হলো মাদ্রাজের Indian Ladies Magazine-এ। ১৯০৫ সালে। উপমহাদেশের নারীমুক্তি আন্দলোনের দিগন্তে উদয় হলো নতুন মুক্তি সূর্য্যের। বেগম রোকেয়া।

রংপুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম বেগম রোকেয়ার। গোঁড়া পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষা (মানে কোরান ইত্যাদি পড়া) ছাড়া অন্য কোনো রকম শিক্ষার অধিকার ছিলনা রোকেয়া ও তাঁর বোনেদের। এমনকি মেয়েদের বাংলা পড়া ও লেখার কোনো অধিকার ছিল না। (সেই সময় সম্ভ্রান্ত কিছু মুসলিম পরিবারে উর্দুকেই মনে করা হতো জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম, বাংলা নয়)। অথচ তাঁর ভাইয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স ও পরে বিলেত যাওয়ারও সুযোগ পান। এই দাদা ইব্রাহিম সাবের বিলেত থেকে ফিরে এলেন পাশ্চাত্যের খোলা হাওয়া নিয়ে। পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শুরু হলো। কিন্তু তাঁদের বাবার বিরোধিতা কমল না। রোকেয়ার বিয়ে হয়ে গেল ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শাখাওয়াত হুসেনের সঙ্গে, ১৬ বছর বয়সে। স্বামী তাঁকে লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতেন আর বেগম রোকেয়া নিজের চেষ্টায় শিখেছিলেন বাঙলা ও ইংরেজি।

নিজের লেখালেখি, রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ এবং শিক্ষা প্রসারের জন্য একসঙ্গে কাজ করে গেছেন বেগম রোকেয়া। ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে নবপ্রভা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম প্রবন্ধ। কিন্তু ১৯০৯ থেকে ১৯১৪-র মধ্যে একটা অধ্যায়ে দেখে পাই যে নিজের সাহিত্য সৃষ্টি যেন থেমে গেছেন। এই সময়টা ব্যক্তিগত জীবনে প্রচন্ড ঝড়ঝাপ্টার সম্মুখীন হয়েছেন। মা- বাবা, স্বামী আর দুটি শিশুকন্যার মৃত্যু এই সময়। তারপর স্বামীর মৃত্যুর পর সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে চরম দুর্ব্যবহার পান তাঁর সৎ মেয়ে ও জামাতার কাছ থেকে। তা সত্বেও হিম্মত হারাননি। হননি লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত। জনৈক মিঃ ইয়াসিন-কে লেখা একটা চিঠির উল্লেখ পেলাম তথ্যপঞ্জিতে। সেখানে উনি লিখছেন – 
“You need not feel so keenly about me, I do not repent for leaving Bhagalpur, but at times I feel some sort of yearning to see the grave of my husband and the tiny graves of my babies. But never mind. I am brave enough to bear my grief.”

জীবনের শেষ রাতেও নিয়োজিত ছিলেন সৃষ্টি কর্মে। “নারীর অধিকার” নামে সেই অসম্পূর্ন রচনা প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর, ১৯৫৭ সালে।

বাংলায় নবজাগরণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ স্ত্রীশিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের অঙ্গীকার। এই প্রদীপ শিখা সেই ভাবে পৌঁছতে পারেনি মুসলিম পরিবারগুলির অন্দরমহলে। নিজের সমাজে বেগম রোকেয়া যেন সেই অন্ধকারনাশিনী আলোকবর্তিকা। সেই দিশায় স্থাপিত শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান। প্রথম দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে ছাত্রী জোগাড় করেছেন। তাঁদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা আর পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়েছে স্কুল। এ যেন সিস্টার নিবেদিতার স্কুল শুরুর দিনগুলির অ্যাকশন রিপ্লে !!

প্রাচীনপন্থী গোড়া সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়ন, এমনকি পড়াশোনা অধিকারও অত্যন্ত স্পর্শকাতর এক বিষয়। গতানুগতিক সামাজিক প্রথা অনুযায়ী যার বিরোধিতা হয়ে এসেছে নানা সময়ে। তাই বেগম রোকেয়ার প্রতি অকরুণ মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিলেন সমাজের প্রভাবশালী অংশ। এই টানাপোড়েনে তিনি মাটি পেলেন না তাঁর প্রিয় শহরের কোনো গোরস্থানে। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় পানিহাটিতে। এর বহু বছর পর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্বর্গত অমলেন্দু দে সেই সমাধি স্থান চিহ্নিত করেন। স্থানীয় পৌর প্রশাসনের তরফে স্থাপিত হয় একটি ফলক। পানিহাটির বালিকা বিদ্যালয়ের ভেতরে।

জানতাম যে পানিহাটি ত্রাণনাথ স্কুলের কোনো জায়গায় আছে সমাধিটা। তবে সঠিক স্থানটি জানা ছিল না। তাই প্রথমে প্রাথমিক স্কুলেই ঢুঁ মারি। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, সাধারণত প্রাইমারি স্কুলের কর্মীরা বেশি approachable হন। এক্ষেত্রেও অন্যথা হলো না। স্কুলের এক কর্মী বলে দিলেন সঠিক দিকনির্দেশ। তারপর আর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি খুঁজে পেতে বেগম রোকেয়ার গোর।

সোমবার সকাল। মেয়েরা ভিড় করে পানিহাটি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে। তারপর সেই স্মৃতিফলকটির সামনে দিয়ে একে একে তারা ঢুকে যায় ক্লাসে। অনুভব করি যে, সংগ্রাম সংঘর্ষের পরম্পরায় মেরি উলস্টোনক্রাফট কিংবা সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর থেকে কোনো অংশে কম নয় বেগম রোকেয়ার উপলব্ধি। অনেকদিন আগে শোনা নাগরিক কবিয়ালের গানটি আবার মনে পড়ে।

“মেয়েদের স্কুল ডুমুরের ফুল
সে ফুলের টানে বাতাস আকুল
কাহিনী লেখিকা, প্রবন্ধটাও
যুক্তি তর্কে কলমখানাও, আপনি শানিয়েছেন
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।”

স্মৃতিফলকের ছবি আমার তোলা (23.04.2018)
বেগম রোকেয়ার ছবি: internet

2 comments

  1. খুব ভাল আপনার বা আপনাদের লেখা। আর অনেক তথ্যপূর্ণ। পাণিহাটিতে ছোট থেকে বড় হওয়ার সুবাদে আমি আগ্রহী আরো কিছু জানতে। যেমন বেগম রোকেয়ার উদ্দেশে এই কবিতা কার লেখা। দুই, বারো মন্দির ঘাটে যে শ্বেত পাথরের অসাধারণ সব মূর্তি ছিল যা এখন আর দেখা যায়না, সেগুলো কার সংগ্রহ। যদি জানেন, জানাবেন। পার্থ সারথি

    Like

    • আমাদের লেখা পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
      আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে জানাই, উদ্ধৃতি দেওয়া অংশটি কবীর সুমনের রচনা। সম্পুর্ন কথা ও সুর নিচের লিঙ্কে পাবেনঃ
      https://sumanami.co.uk/বেগম-রোকেয়া/
      দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর আমাদের সঠিক জানা নেই। তবে দত্তবাবুদের নির্মিত ঘাট ও মন্দিরে তাঁদের স্থাপিত মূর্তি থাকাই স্বাভাবিক। বারো মন্দির ঘাট নিয়ে এই ব্লগে একটি লেখা আছে। নিশ্চয়ই দেখেছেন।

      Like

Leave a comment