পুণ্যার্থীদের পথ ধরে….( চিৎপুর প্রথম ভাগ)

টিটাগড়ে একটা কাজে গিয়েছিলাম। সকাল সকাল মিটে গেল। ফেরার পথে মা বলে দিয়েছে লক্ষ্মী পুজোর জন্য কয়েকটা জিনিস বাজার থেকে নিয়ে যেতে। এদিকে বাজার বসে তো সেই সন্ধে বেলা। একবার বাড়ি ঢুকলে আবার বেরোতে ইচ্ছে করে না। কি করি – কি করি … ভাবতেই মনে হলো আদি চিৎপুরের দিকে হেরিটেজ-গুলি এখনো দেখা হয়নি, একটু ঘুরে যাই।
ডানলপ ব্রিজ পর্যন্ত অটোতে এসে তারপর বাসে চড়লাম। নামলাম চিড়িয়ামোড়। রাস্তা পার হয়েই খগেন চ্যাটার্জি রোড – আজকের গন্তব্য।

সিমেন্টে বোঝাই লরি গা ঘেসে চলে যায়। ভাঙা রাস্তার গর্তে পড়ে লাফিয়ে ওঠে লরিটা। সিমেন্টের ধুলোয় ঝাপসা হয়ে যায় চারদিক। ধুলোর ঝড়ের মধ্যে দিয়েই দেখা যায় চিৎপুর ইয়ার্ডের রেল লাইন। জানা গল্প। তবু মনে মনে আরো একবার ঝালিয়ে নিতে নিতে পথ হেঁটে যাই। হুগলি নদীর জলীয় বাষ্প আর ঘিরে থাকা গরান গেঁও সুন্দরী গাছের ঘন জঙ্গলের অস্পষ্টতায় ইতিহাস আর লোকগাঁথা মিলে মিশে তৈরী হয় শহরের প্রাচীনতম দিনগুলির আলেখ্য।

শহর পত্তন হওয়ার অনেক আগে থেকেই কালীঘাটের কালী ক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই শ্বাপদ সংকুল পথ। মুর্শিদাবাদ থেকে কালীঘাট যাওয়ার এই পথ দিয়েই চলেছে পুণ্যার্থীদের সারি। এমনই কোনো অঘ্রায়ণের বিকেল। একটু পরেই আলো মরে আসবে। যাত্রীরা পা চালায়। তবু শেষ রক্ষা হয় না। ঝোঁপের আড়াল থেকে স্পষ্ট শোনা যায় – হা রে রে রে। লুঠতরাজ, নরবলি, রক্তপিপাসু দেবী – কিছু বাস্তব আর বাকিটা কল্পনা দিয়ে মানুষ তৈরী করে রোমাঞ্চকর এই উপাখ্যান। সেই চিতে ডাকাতের উপাস্য দেবীই চিত্তেশ্বরী। সেই থেকেই জায়গার নাম চিৎপুর।

ধুলো মাখা পথের দুই ধারে সারি সারি গুদামঘর বিশাল অজগরের মতো শুয়ে। রেল থেকে মাল উঠে গোডাউনে ঢোকে আবার সেখান থেকে বেরিয়ে পাড়ি দেয় নিজস্ব গন্তব্যের দিকে। ছোট ভ্যানে করে এক গুদামে মাল নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রৌঢ়। ভারী ভ্যান ঠেলছে আরেকজন। ঘামে লেপ্টে গেছে পরনের আধ ময়লা গেঞ্জি।

জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা, আদি চিত্তেশ্বরী মন্দিরটা কোন দিকে বলতে পারবেন ?
কাঁধের গামছা দিয়ে মুখ মুছে কম বয়সী সঙ্গীকে প্রশ্নটা ফিরিয়ে দিলেন। বুঝলাম ঠিক বুঝতে পারছিলেন না। আরো স্পষ্ট করে বললাম – মন্দির, খুব পুরনো মন্দির।
এবার যেন বুঝতে পারলেন – আপ সর্বমঙ্গলা মন্দির কা পাতা তো নেহি পুঁছ রহেঁ হো?

আমি বুঝলাম যে আদি চিত্তেশ্বরী মন্দির বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে অবাঙালি অধিবাসীর। আগে দেখা গুগুল ম্যাপটা মনে করলাম। আদি চিত্তেশ্বরী আর সর্বমঙ্গলা চিত্তেশ্বরী – দুটো মন্দির-ই কাছাকাছি হওয়া উচিত। দুটি মন্দির-ই কর্পোরেশনের হেরিটেজ তালিকায় আছে। একটা খোঁজ পেলে আর একটা খুঁজে নিতে অসুবিধা হবে না। পথ নির্দেশ পেয়ে গেলাম। সোজা রেল লাইন পেরিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে গেলেই পাওয়া যাবে চৌমাথা, সেটা পেরিয়েই ডান হাতে পড়বে সর্বমঙ্গলা মন্দির।

এগিয়ে যাই সেই মতো। বাঁ হাতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের “শহর বাংলা কবরখানা”। এটাও হেরিটেজ তালিকাভুক্ত। তারাপদ সাঁতরা জানিয়েছেন যে কলকাতা শহরের প্রাচীনতম মুসলিম বসতি এই এলাকাতেই গড়ে উঠেছিল। সব থেকে পুরোনো মসজিদটিও এই ওয়ার্ডের মধ্যে পরে। অনেক বছর আগেই সেটির দুর্দশার কথা লেখা আছে ‘কলকাতার মন্দির মসজিদ’ বইটিতে । দেখতে হবে আজ কি অবস্থায় আছে বশির শাহের মাজার ও দুই শতাব্দীর বেশি প্রাচীন সেই মসজিদ। খুব একটা আশা যে মনে জাগে, তা নয়। পুরোনোকে ত্যাজ্য করে নতুনের দিকে ঝোঁক চারিদিকে। নীল আকাশকে প্রেক্ষাপটে রেখে নীল গ্লেজড টালি বসানো চকচকে পাঁচ তলা নতুন মসজিদটি চোখ পড়ে।

চৌমাথা ছাড়িয়ে ডান হাতে নজরে এলো হলুদ মন্দির। বিপ্রদাস পিপলাই-এর ‘মনসামঙ্গল’-এও উল্লেখ আছে- ‘চিতপুরে পূজে রাজা সর্বমঙ্গলা’! তবে অনেকে মনে করেন যে এই সব কথা অন্য কেউ পরে ঢুকিয়েছেন। সেই তর্ক থাক। মন্দির দেখি। সামনে পূজা উপচারের জমাট বেসাতি। জবার মালা, লাল চেলি, ধূপকাঠি মোমবাতি, প্রসাদ। সন্ধ্যার সময় যারা পুজো দিতে আসবেন- তাদের জন্য দোকান সাজাতে ব্যস্ত দোকানিরা। একজন দুজন করে পুণ্যার্থীরাও আসতে শুরু করেছেন। তার মাঝেই ট্যাক্স কনসালটেন্ট আর “মাতা কি জাগরণের” হিন্দি ফ্লেক্স টাঙানো। হিন্দিতেই দুর্গা পূজা, দীপাবলি ইত্যাদির উৎসবে এলাকার জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন স্থানীয় এমএলএ। বেশ একটা জমজমাট ভাব। বাইরে জুতো রেখে ভেতরে ঢুকি। সামনের নাটমন্দিরে সাত-আটজন অবাঙালি পুরোহিত সন্ধ্যার জন্য তৈরী হচ্ছেন।

দালান রীতিতে তৈরী সমতল ছাদের মন্দির। কিন্তু পরে যোগ করা হয়েছে মূল গর্ভগৃহের উপর আটচালার শিখর। কোথাও ছবি তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা লেখা নোটিশ বোর্ড চোখে পড়লো না। তার উপর হেরিটেজ সাইট। মন্দির স্থাপত্যের কটা ছবি তুললাম মোবাইলে। গায়ের অলঙ্করণের ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বের করতেই রে রে করে দুজন কর্মকর্তা সাথে সাথে আরও একজন পুণ্যাথী।
– ইয়াহা ফটো খিঁচনে পর পাবন্দী হ্যায়। ক্যামেরা মত নিকালিয়ে।

অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি, এই সব অবস্থায় তর্ক, আলোচনায় কাজ হয় না। কথা না বাড়িয়ে যেখানে জুতো ছেড়ে রেখেছিলাম, সেই দিকে এগিয়ে যাই।

চোখে পড়ে কাশিপুর গান শেল ফ্যাক্টরির গেট আর লাগোয়া ঘড়ি মিনার। এই মিনারটিও হেরিটেজ তালিকা ভুক্ত। কিন্তু আরও অনেক ঐতিহ্যের মতো তার অবস্থাও সঙ্গিন। অচল ঘড়ি, গায়ে গজানো বটগাছ আর মিনারের উপর নিঃশব্দ ঘন্টাটা মনে করিয়ে দেয় অতীত গৌরব। এই কারখানাই ভারতের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আধিপত্য বিস্তারের কৌশল হিসাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে পেশী শক্তিকে। প্রতিদিন শুরু হচ্ছে নতুন নতুন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে নিয়ন্ত্রক শক্তি আগেয়াস্ত্র। ফোর্ট উইলিয়াম তৈরী নতুন কামানের জন্য চাই ক্যারেজ – চাকা লাগানো শকট। সাবেক কলকাতার কাছে বড় পাইকারি কাঠের বাজার ছিল চিৎপুরে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কামান এনে তার ক্যারেজ তৈরীর জন্য এই জায়গাটা পছন্দ হয়েছিল কোম্পানির কর্তাদের। এখানেই ১৮০১ সালে নির্মাণ শুরু হলো গান ক্যারেজ এজেন্সির। তারপর এখানে তৈরী হতে শুরু হলো কোম্পানির কামান। কারখানার নাম বদলে হলো গান ফাউন্ড্রি। একটা পথ নির্দেশ এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই কথা। গঙ্গার ঘাট থেকে বি টি রোড পর্যন্ত পুব-পশ্চিমে টানা রাস্তাটার সাবেক নাম ছিল গান ফাউন্ড্রি রোড। তারপর সেখান থেকে গান শেল ফ্যাক্টরি।

বাড়ি ফিরে নেট ঘাঁটছিলাম এই ক্লক টাওয়ারের উপর তথ্যের জন্য। নজরে পড়লো গান শেল কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত টেন্ডার। আনুমানিক আট লক্ষ টাকার উপর অর্থ মূল্যের এই টেন্ডার বেরিয়েছে এ বছর জুলাই মাসে – ঘড়ি মিনার সারাই করার জন্য। আশা জাগে, অদূর ভবিষ্যতেই আবার সচল হবে মিনারের ঘড়ি। বেজে উঠবে উপরে রাখা ঘন্টাটা। পথচলতি মানুষকে আবার মনে করবে এই ধুলোমাখা পথের অতীত।

কথায় কথায় এসে পড়লাম গঙ্গার ঘাটে। সেখানেও সর্বমঙ্গলা সংকীর্তন সমিতি। কিন্তু আদি চিত্তেশ্বরী মন্দির কোথায়? দুজন কলকাতা পুলিশের কর্মী ঘাটের ধরে ডিউটি দিচ্ছিলেন। তাদের প্রশ্ন করেও সঠিক উত্তর পেলাম না। অগত্যা নিজের মতো করে খুঁজতে খুঁজতেই ফেরার পথ ধরব ভাবছি – তখনি একজন সিভিক ভলান্টিয়ার বললেন – গান শেলের মেন্ গেটটা ছাড়িয়েই একটা মন্দির আছে দেখুন তো সেটা কি না !

( ক্রমশ )

22339680_10207621809821865_771016448876448486_o

Leave a comment